মতামত ও বিশ্লেষণ

অনিল মারান্ডীর জীবনসংগ্রামঃ পাভেল পার্থ

২০০৪ সনের ১০ ফেব্রুয়ারি। একদিকে বইমেলা চলছে, আরেকদিকে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে দীপায়ন খীসা ও আমি দৌড়ে বেড়াচ্ছি ‘মাওরুম’ নামের একটি পত্রিকার প্রচ্ছদের জন্য। হঠাৎ খেয়াল হলো অনিল মারান্ডী অপেক্ষা করছেন বইয়ের দোকান পাঠক সমাবেশের সামনে। তখন তিনি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি। বাসায় ফেরার পর প্রচ্ছদসহ খসড়া মাওরুমখানি দেখাই তাঁকে। দীর্ঘসময় নিয়ে খসড়াখানি দেখার পর তিনি জানান, দেশজুড়ে আদিবাসীরা নির্দয় যন্ত্রণায় আছে, একটি কী একাধিক পত্রিকা এই যন্ত্রণা তুলে ধরতে পারবে না। কিন্তু আমাদের থামলে চলবে না, এই যন্ত্রণার ভেতর যে সংগ্রাম জীবন্ত আছে তা সবার সাথে মেলাতে হবে। ভাতের থালায় আলু ভর্তা আর ঘন ডালের ওপর তাঁর ছায়া নেমে আসে, কী প্রবল সেই ছায়ার আওয়াজ, আজো কলিজায় ঝনঝন করে ওঠে। অনিল মারান্ডীর সাথে আমার সাক্ষাত ১৯৯৫ সনের পরপর, কিন্তু সখ্য গড়ে ওঠে তারও কয়েক বছর বাদে। এরপর দেশজুড়ে কত মাটিজলে, কত রক্তকাদায় তাঁর লগে হেঁটে যাওয়ার সাহস করেছি। ভীমপুর থেকে নাচোল, কাঁকনহাট থেকে গোবিন্দগঞ্জ, চাবাগান থেকে রাঙামাটি, ফুলবাড়ী থেকে রংপুর, বরেন্দ্র থেকে রাজধানী। ২০১৯ সনের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার পাঁচগাছিয়া গ্রামে অনিল মারান্ডী চলে গেছেন না ফেরার দেশে। চলতি লেখাটি অনিল মারান্ডীকে ঘিরেএক ধরণের স্মৃকিকথন, বলা ভাল তাঁকে যেমন দেখেছি এই ধাঁচের একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের কোনো ফিরিস্তি এটি।
২.
অনিল মারান্ডী ছিলেন একজন তুখোড় বক্তা। ২০০৭ সনের ১২-১৪ এপ্রিল রাজশাহীর ভুবনমোহন পার্কে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও আস্থা আয়োজিন করে এক বর্ণাঢ্য ‘আদিবাসী লোক উৎসব’। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও সেলিনা হোসেন, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালসহ কত শ্রদ্ধেয়জনে ভরপুর ছিল সেই উৎসব। উৎসবের মূলপ্রবন্ধখানি তৈরির পর অনিল মারান্ডীসহ আদিবাসী পরিষদের সামনে পাঠ করি। অনিল মারান্ডী প্রবন্ধের নাম চূড়ান্ত করেছিলেন, ‘কার ভাষা-কারসংস্কৃতি-কার রাষ্ট্র?’ অনিল মারান্ডীর শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাস ছিল অসাধারণ। কী অনর্গল বক্তৃতা করতেন বাংলায়, সাঁওতাল গ্রামে তাঁর সাঁওতালি আলাপ শোনার সৌভাগ্যও হয়েছে আমার। আমি তাঁর একজন বিমুগ্ধ শ্রোতা। ২০০৮ সনের ১৫ জুন জয়পুরহাটের পাঁচবিবির মহিপুরে আদিবাসী নারী কল্যাণ সংস্থা সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসের এক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বাংলা ও সাঁওতালি ভাষায় এক অনবদ্য বক্তৃতা দিয়েছিলেন অনিল মারান্ডী। একই সনের ২০ অক্টোবর আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সম্মেলনে রাজশাহীতে কিংবা ২০১২ সনের ৩০ জুন দিনাজপুর নাট্য সমিতিতে দেয়া তাঁর বক্তৃতার ছলকানি এখনো শিরায় শিরায় তড়পায়।

৩.
তিনি ছিলেন একজন মেধাবী বিশ্লেষক। খুব সহজে যেকোনো বিষয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে পারতেন। তবে এই বিশ্লেষণ তিনি করতেন আদিবাসী জগতের প্রান্তিকতার চশমা দিয়ে। এই বিশ্লেষণে আহাজারি যেমন থাকতো, থাকতো তেমনি দ্রোহের ঝাঁঝ। যেকোনো একটা বিষয়ে কিছু সময় আলাপ করলেই তিনি বিষয়টি সামগ্রিকতার পরিধিতে ফেলে আলাপ জমাতে পারতেন। যতবার আমি নওগাঁর মহাদেবপুরের নাটশাল মাঠে কারাম উৎসবে গেছি, ততবার তাঁর আলোচনার বিশ্লেষণগুলো খেয়াল করবার চেষ্টা করেছি। সবসময় তিনি আদিবাসী জাতিসমূহের প্রান্তিকতাকে রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক নিষ্ঠুর নিয়ন্ত্রণ হিসেবে দেখেছেন। ২০১২ সনের এক আলোচনার কথা টানা যাক। রংপুর পর্যটনকেন্দ্রে আদিবাসী পরিষদ ও কাপেং ফাউন্ডেশন ১৭ জুলাই ‘আদিবাসী ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার’ শীর্ষক এক আলোচনার আয়োজন করে। অনিল মারান্ডীর ভাষ্য, রাষ্ট্র ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে স্বীকার করে কিন্তু আদিবাসীরা হাজার বছর ধরে এসবের গোষ্ঠীগত মালিকানার সংস্কৃতি বহন করে এসেছে, আর সমস্যাটার সূত্র এখানেই। এখানেই আদিবাসী ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ঘিরে যে চিন্তা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের এই চিন্তা না পাল্টালে আদিবাসীদের ভূমি লুট হতেই থাকবে। একমাত্র আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের এই চিন্তা পাল্টানো সম্ভব।’’

৪.
কোনো ক্লান্তি ছিল না তাঁর, বলা ভাল সকল ক্লন্তির ছাপ তিনি লুকিয়ে রাখতেন এক আশ্চর্য জাদুবিদ্যায়! ২০১৫ সনের ১৫ থেকে ১৬ নভেম্বর। আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে হাজারে হাজার আদিবাসী নারী-পুরুষ হেঁটেছিল দীর্ঘপথ। চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে আমনুরা হয়ে মুন্ডুমালা, কাঁকনহাট, রাজাবাড়ীহাট, কাশিয়াডাঙ্গা মোড় হয়ে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের চত্বর। দীর্ঘ এই পথযাত্রায় দেখেছি অনিল মারান্ডী ক্ষিপ্র ত্যাজে টপকে গেছেন গ্রামের পর গ্রাম। ২০০৫ সনে আমরা যখন হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫০ বছর পূর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি দারুণ উৎসাহে, তখন হঠাৎ আমাদের এক নতুন দুশ্চিন্তায় পড়তে হলো। ৩০ জুন ঘোষিত হলো হরতাল কর্মসূচি। কাংখিত সেই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল পরেরদিন পয়লা জুলাই। অনিল মারান্ডীকে দেখেছি যথাসম্ভব সকলের মনোবল চাঙ্গা রাখার কারসাজি গুলো হাজির করতে।

৫.
বাংলাদেশের নানাপ্রান্তে ঘটে যাওয়া সকল আদিবাসী নির্যাতন নিপীড়নের ঘটনায় তিনি সমানভাবেই তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। নিজে সাঁওতাল জাতির ও বরেন্দ্রভূমির মানুষ হয়েও সকল অঞ্চলের আদিবাসী জাতির জন্য একই টান অনুভব করেছিলেন। ২০০৭ সনের ১৮ মার্চ টাঙ্গাইলের মধুপুরের মান্দি আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলকে হত্যা করা হয়। পরের বছর ১৮ মার্চ অনিল মারান্ডী আমাকে ফোন করেন। চলেশের মৃত্যুর প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে সমকালে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। আমি সব খুঁজে ঐদিন আরেকটি লেখা পাই, ফাদার সুব্রত বনিফাস টলেন্টিনো লিখেছিলেন দৈনিক সংবাদে। অনিল মারান্ডীকে সেই লেখাটি পাঠাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলে জাতীয় আদিবাসী পরিষদই প্রথম মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে ঘিরে অনুষ্ঠান আয়োজনের সূচনা করে, অনিল মারান্ডী ছিলেন এর এক মূখ্য সংগঠক। কল্পনা চাকমার নিখোঁজের প্রতিবাদ বা ইকোপার্ক বিরোধী কর্মসূচি, জাতীয় মুন্ডা সম্মেলন বা চান্দপুর-বেগমখান চাবাগান আন্দোলন, বৃহত্তর সিলেটের খাসি পুঞ্জি জবরদখলের বিরুদ্ধে কী সমুদ্র উপকূলে রাখাইন ভূমিদখলের বিরুদ্ধে আয়োজিত সকল কর্মসূচিতেই তিনি ছিলেন একজন অগ্রগণ্য সংগঠক। ২০১৬ সনের ৬ ডিসেম্বর রাজশাহী ভূবনমোহন পার্কে যখন আমরা গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল-বাঙালিদের উপর হামলা ও নিহতের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করছি, অনিল মারান্ডী অসুস্থ শরীর নিয়ে তখনো এক দুর্দান্ত আলোকশিখা হয়েছিলেন।

৬.
নানাভাবে নানা আয়োজনে উত্থাপিত অনিল মারান্ডীর দুর্দান্ত সব ভাষ্য আজো স্ফূলিঙ্গ হয়ে আছে। আদিবাসীদের নিয়ে প্রশ্নহীন নানাবিধ গবেষণা ও অপরত্বের বাহাদুরিকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন। ‘গবেষণার নামে আদিবাসীদের ব্যাঙের মতো কেটে কেটে পরীক্ষা করা হয়, আদিবাসীরা কারো গবেষণার ব্যাঙ হওয়ার জন্য জন্মায়নি’। অলচিকি, বাংলা না পরিবর্তিত রোমান কী হতে পারে সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা এ নিয়ে এখনো বাংলাদেশে কোনো চূড়ান্ত সুরাহা হয়নি। এ প্রসঙ্গে অনিল মারান্ডীর মন্তব্য, একমাত্র সাঁওতালি লিপিতেই পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হলে সাঁওতাল জাতি ও আগামী প্রজন্ম স্বাচ্ছন্দ্যে ভাষা, সাহিত্য চর্চা সংরক্ষণ ও লালনপালন করতে পারবে।’

৭.
অনিল মারান্ডী ছিলেন একজন আজন্ম বিপ্লবী। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ীহাটের কাছে বাদুরঝোলা গ্রামে ১৯৫৬ সনের ১১ অক্টোবর এক সাঁওতাল পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। মায়ের নাম মেরী ম্যাগডালিনা হেমব্রম ও বাবার নাম ফিলিপ সুফল মারান্ডী। অনিলের দাদু ‘লাল বুঢ়হা’ বার্থলেমেও কোটা মারান্ডী ছিলেন একজন জাঁদরেল সাহসী মানুষ। অনিলের বিপ্লবী জীবনের হাতেখড়ি তাঁর তুখোড় প্রতিবাদী মায়ের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে সহযোগিতা ও পুকুর খননের কাজ করতেন অনিলের বাবা, কাকা লুইস তানো মারান্ডী চিকিৎসা দিতেন গ্রামে গ্রামে। এর ভেতরে বাড়িতে বড় ধরণের ডাকাতি হলে অনিলের পরিবার চলে আসেন গোদাগাড়ীর পাঁচগাছিয়া গ্রামে। আন্ধারকোটা মিশন স্কুলে প্রাথমিক উত্তীর্ণের পর হরিপুর কসবা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন অনিল। পরবর্তীতে প্রেমতলী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। বরেন্দ্র অঞ্চলের আর সব সাঁওতাল জীবনের মতোই তাঁর পরিবারেও ভূমি ও সম্পদ বেহাত হওয়ায় আর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন আগায়নি। সারাজীবন এক গরিবি যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু শত ঝঞ্জার ভেতরও দমে যাননি, মাথা নত করেননি। পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের ভেতর তিনি ছিলেন সবার বড়। ১ কন্যা ও ২ পুত্রের জনক অনিল মারান্ডী কৃষিজমিনে রোয়া লাগিয়ে এবং নব্বইয়ের দশকে রিকশা চালিয়ে টেনেছেন সংসার। ১৯৯২ সনে তাঁর লগে পরিচয় হয় আরেক আজন্ম বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথ সরেনের। ১৯৯২ সনের এক পৌষের সকালে রাজশাহীর কাঁকনহাটের সুন্দরপুর সাঁওতাল গ্রামে তারা এক আদিবাসী সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্ধুদ্ধ হন। ১৯৯৩ সনে গঠিত হয় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। ১৯৬২ সনে টাঙ্গাইলের মধুপুরে গঠিত ‘জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদের’ পর এটিই ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধারণ করে দেশের অন্যতম এক গণসংগঠন। অনিল মারান্ডী এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুকালে তিনি এই সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। আদিবাসী পরিষদের ৯ দফা প্রণয়নে রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। যখনই পেরেছেন তিনি ছুটে গেছেন আদিবাসী গ্রামে, বিচারের দাবিতে দাঁড়িয়েছেন রাজপথে। বিচার না পেয়ে নিজেই নির্বাচনের মাধ্যমে আদিবাসীদের জন্য সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্যও লড়াই করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচন করেছেন, উপজেলা ভাইসচেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছেন, ২০০৮ সনে নওগাঁ-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করেছেন।

৮.
কেবল সংগঠন বা রাজপথ নয়, অনিল মারান্ডী ব্যক্তিগত নানাবিধ খোঁজখবরও নিয়মিত রাখতেন। ২০১২ সনের ডিসেম্বরে মুর্মূষু মাকে নিয়ে সিলেট রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে ছিলাম। অনিল মারান্ডী ফোন করে সাহস জোগাতেন, দু:খকে জয় করবার সাহস। ২০০৮ সনের মার্চে এন্ড্রু সলোমার, গোবিন্দ বর্মন, সবিন চন্দ্র মুন্ডা, রবীন্দ্রনাথ সরেন ও অনিল মারান্ডী সকলে মিলে কিছুদিন আমাদের বাসায় ছিলাম। কত গল্প হয়েছে তখন, কারামের গীত থেকে গেরিলা যুদ্ধ কত কী! অনিল মারান্ডী পরোটা-মাংশ খেতে পছন্দ করতেন। সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর জান্নাত হোটেলে যেতাম। আমাদের কারোর পকেটই তখন ভরপুর ছিল না। খুব কায়দা করে আমরা অনিল মারান্ডীকে পেট ভরে খাওয়াতাম, বাসায় এসে অন্যরা রান্না করে খেতাম। মূলত খাওয়ার পর অনিল মারান্ডীর এক অবিস্মরণীয় হাসির জন্যই আমরা অপেক্ষা করতাম। কিন্তু বাসায় এসে যতক্ষণ না আমরা সকলে খেয়েছি ততক্ষণ অনিল মারান্ডী ঠায় বসে থাকতেন। সকলের খাওয়া শেষ হলে আবার সেই অবিস্মরণীয় হাসিতে ভরিয়ে তুলতেন চারধার। জানি এই হাসির কোনো মৃত্যু নেই। কাল থেকে কালে, জাতি থেকে জাতিতে, ঘর থেকে জমিনে এই হাসি ছড়িয়ে আছে সবখানে।

৯.
অনিল মারান্ডী সবসময় ব্যক্তি নয়, সমষ্টির চিন্তা করতেন। ১৪ বছর বয়সে তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে মুক্তিসেনাদের সাথে চলে যান অনিল, অনেক কসরৎ করে তাঁর পরিবার তাঁকে ফেরত আনে। কত রাত কত দিন নিরন্ন নিজ পরিবারকে ফেলে ছুটে গেছেন কত শত আদিবাসী গ্রামে। একদিন ঘরে কোনো খাবার নেই, অনিল ভোরে ছুটছেন এক আদিবাসী গ্রামে হামলার প্রতিবাদে। অনিলের স্ত্রী আগাথা মুর্মু বলেন, ‘আমরা পাঁচজন মানুষ এখানে না খেয়ে আছি’। যেতে যেতে অনিল বলেছিলেন, ‘এখানে আমরা পাঁচজন না খেয়ে আছি, কিন্তু আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে অনেক মানুষ না খেয়ে আছে’। অনিল মারান্ডীর সামগ্রিক বিপ্লবী জীবনকে পাঠ করে আমরা এই সমষ্টির প্রতি সংবেদনশীল এক মানুষের দেখা পাই। আজ এই নিদারুণ সময়ে অনিল মারান্ডীর সমষ্টির প্রতি সংবেদনশীলতার শিক্ষাকে আমাদের জাগিয়ে রাখা জরুরি।

……………………
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক।

Back to top button