অন্যান্য

অনলাইন ক্লাস: অংশ নিতে পারছেন না অধিকাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থী

সতেজ চকমা: করোনার কারণে লন্ড ভন্ড সকল প্রকার স্বাভাবিক কার্যক্রম। এই মহামারীর কারণে বিগত তিন মাসের অধিক সময় ধরে দেশে বন্ধ রয়েছে সকল ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। যার ফলে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষাবিদরা বলছেন এমনি একটা কঠিন সময়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী এবং সচল রাখার জন্য অনলাইন কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের নিজেদের উদ্যোগে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সংসদ টিভি’র মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস চলমান রয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে।

কিন্তু এমনি অপরিকল্পিত এবং অপ্রস্তুত এ ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারছেন না অনেক শিক্ষার্থী। তার মধ্যে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এই ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বেসরকারী সংস্থা ব্রাক এর সাম্প্রতিক এক জরিপ এ উঠে এসেছে যে, আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫% শিক্ষার্থী নানা কারণে এই অনলাইন ক্লাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিভিন্ন সমস্যার কথা।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি’র পানছড়ি উপজেলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নিকেল চাকমা আইপিনিউজকে বলেন, আমাদের এখানে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পর্যন্ত নিয়মিত লগইন করা যায় না। আমার বাড়ী থেকে অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয়া একেবারেই সম্ভব নয়। বাড়ীর বাইরে অপেক্ষাকৃত উঁচু টিলা কিংবা দূরবর্তী আত্মীয়ের বাড়ি এসে কোনো মতে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিচ্ছি। ক্লাসের বাকী বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে পড়ার ভয় থেকে এত কষ্ট করে ক্লাসে অংশ নেওয়ার এ প্রয়াস বলেও জানান এই শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বান্দরবানের শিক্ষার্থী দনওয়াই ম্রো বলেন, আমার বাড়ি যে প্রান্তে সেখানে তো ভালোভাবে নেটওয়ার্কই পাওয়া যায় না। মোবাইলে কথা বলতেও উঁচু জায়গায় গিয়ে কথা বলতে হয়। তাছাড়া অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়ার জন্য ন্যুনতম যে এন্ড্রয়েড সেটটি দরকার সেটা আমার নেই। অন্যদিকে অনলাইনে এক্সেস নেওয়ার জন্য যে সার্ভিস চার্জ সেটা বেশ ব্যয়বহুল। অনলাইন ক্লাস নিয়ে এভাবেই তাঁর দু:শ্চিন্তার কথা জানান এই শিক্ষার্থী।

এদিকে ময়মনসিংহের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী পূণ্ণা স্কু আইপিনিউজকে বলেন, আমার গ্রামের বাড়ীর ভেরতে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুব নিম্মাননের। যার জন্য বাড়ীর বাইরে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় গিয়ে ক্লাস করতে হয়। এক্ষেত্রে ক্লাসে মনসংযোগ করা কিংবা নোট করতে বেশ অসুবিধা।

একই সমস্যার কথা আইপিনিউজকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক আদিবাসী শিক্ষার্থী পুষার রতন ত্রিপুরা। এই শিক্ষার্থীর বাড়ী খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়িতে।ক্লাসে অংশগ্রহনের জন্য আর্থিক টানপোড়নের মধ্যেও একটি নতুন এন্ড্রয়েট সেট নিয়ে কোনো মতে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন বলেও জানান এই শিক্ষার্থী।

এ বিষয়ে এক মুঠো আলাপে আদিবাসীদের মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা আইপিনিউজকে বলেন, আমরা কেবল ডিজিটালাইজড করছি কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য যে ধরণের চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলোর কথা ভাবছি না। তৃণমূল পর্যায়ের প্রান্তিক মানুষ আসলে এ বিষয়ে কতটা প্রস্তুত তা ভেবে দেখা উচিত।

তিনি আরো বলেন, যেখানে পাহাড়ের অনেক আদিবাসী অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই, নেটওয়ার্ক নেই সেখানে সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কীভাবে এই অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হবেন। কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ করার আগে সেটার কার্যকারীতা আসলে কতটুকু তা না বুঝে প্রয়োগ করলে যা হবার আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রধান এই নির্বাহী।

এদিকে এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক ড. মেসবাহ কামালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, করোনা মোকাবিলায় সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণেই আজকে এ পরিস্থিতি।সরকারের অব্যবস্থাপনার ফলেই দীর্ঘ হচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের তো আমরা দীর্ঘ সময় পড়ালেখা থেকে দূরে রাখতে পারি না। এ অবস্থায় অনলাইন মাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই।

তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা যা বলে তা হচ্ছে অধিকাংশ আদিবাসী শিক্ষাার্থী এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়বে। আমরা মনে হয় না ১০-১৫ শতাংশের অধিক আদিবাসী শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারবে। অনলাইন লেখাপড়ায় যেতে হবে এটা সত্য কিন্তু ‘বেসিক’ যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো সমাধান না করলে আমরা এ থেকে অনেককে বঞ্চিত করবো যেখানে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা থাকবে অধিকাংশ।

মুঠোআলাপে বিশিষ্ট এই আদিবাসী গবেষক আরো বলেন, প্রান্তিক অঞ্চলের অনেক শিক্ষার্থী এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। পাহাড়ের কথা বাদই দিলাম, সমতলের অনেক জায়গায় তো এখনো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। তাছাড়া অনলাইন ক্লাসের জন্য ডাটা সার্ভিসের যে চার্জ সেটা বহন করা অধিকাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব হবে না।

অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা মেধা বা যোগ্যভিত্তিক না হয়ে এক্ষেত্রে আর্থিক সক্ষমতা এবং অবস্থানের সঙ্গতির উপরও নির্ভর করছে দাবী করে তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্র যদি কেবল বড় বড় মেগা প্রজেক্ট এর উপর ঝুঁকে থাকে এবং প্রান্তিক ও গণমানুষের উন্নয়নের জন্য যদি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন না করে তাহলে এধরণের বৈষম্য তো হবেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরকে চাহিদানুযায়ী স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ বা এন্ড্রয়েড মোবাইল সরবরাহ করারও দাবী করেন এই শিক্ষাবিদ। এছাড়া অনলাইন ক্লাস কেবল মাত্র নির্ধারিত সময়ে অংশগ্রহনের আওতার মধ্যে না রেখে সেটা দরকার হলে রেকর্ড রেখে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের দেখে শেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান তিনি।

এ বিষয়ে মুঠো আলাপে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান আইপিনিউজকে বলেন, পাহাড়ের এমনও অনেক এলাকা আছে যেখানে যাওয়ার সহজ কোনো মাধ্যম নেই। হেঁটে পৌঁছতে দিন দু’এক সময় লাগে। সে এলাকার শিক্ষার্থীরা হয়ত এখনও জানতে পারেনি যে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। তাহলে তাদেরকে কীভাবে এই নতুন ব্যবস্থায় সংযুক্ত করা যেতে পারে সে বেপারে অবশ্যই সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহনের অধিকার রয়েছে যা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই সদস্য।

এ বিষয়ে আরো যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং আইপিনিউজকে বলেন, অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবার জন্য সরলীকরণ করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে যেসব আদিবাসী শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করেন তাদের অধিকাংশই গ্রামে বসবাস করেন। এই শিক্ষার্থীরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক সংগ্রাম করে পড়ালেখা করেন। সেখানে অন্যসব শিক্ষার্থীদের সাথে সংগতি রেখে এন্ড্রয়েট ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে এবং ব্যয়বহুল ডাটা সার্ভিস এর বাঁধাকে ডিঙিয়ে এই অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহন করাটা অনেক বেশি দুরহ।
তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থী অনলাইন লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্কের অবস্থানের মধ্যে থাকেন না। তাই আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য যুগোপযোগী ও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা জরুরী। এ ব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে এবং পড়ালেখা থেকে ছিটকে না পড়ে তার জন্য কর্তৃপক্ষকে অন্তত তাদের জন্য শিথিল ও নমনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করারও আহ্বান জানান এই আদিবাসী নেতা।

Back to top button