পাহাড়ে হামে আক্রান্তদের মানবিক সহায়তার উদ্যোগ

সতেজ চাকমা: পাহাড়ে সম্প্রতি হামের প্রকোপ দেখা দিয়েছে বহুলভাবে। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকের প্রত্যন্ত এলাকা, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়ন, বান্দরবানের আলীকদম,লামা,রুমা উপজেলা ও চিম্বুকের বিভিন্ন এলাকার প্রায় তিন শতাধিক মানুষ হামে আক্রান্ত। ইতোমধ্যেই কমপক্ষ্যে ১০ জন শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এটিকে ‘জটিল রোগ’ বা ‘অজ্ঞাত রোগ’ দাবী করে সংবাদ এসেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এবং কাপেং ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে হামে আক্রান্তদের মানবিক সহায়তার জন্য সহযোগীতা উত্তোলন কর্মসূচী চলমান রয়েছে। এই উদ্যোগের সাথে জড়িত মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, এই পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক টাকা আমরা উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছি। বহু আদিবাসী-বাঙালি এবং দেশ-বিদেশের প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী মানুষদের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া পাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, করোনা যেমন সারা বিশ্বের জন্য একটি মানবিক বিপর্যয়। তেমনি এ বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মধ্যে এই হামও পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য আরেকটি বাড়তি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।তাই এ মানবিক বিপর্যয়ে তাদেরকে পুষ্টি জাতীয় খাদ্য সরবরাহ এবং সেই পরিবারগুলোর বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তা প্রদান করার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ।
এক প্রশ্নের জবাবে আইপিনিউজকে তিনি আরো জানান, করোনার এই দুর্যোগে বিভিন্ন জায়গায় লকডাউন চললেও আমরা স্থানীয় হ্যাডম্যান,কার্বারীদের সাথে আলোচনা করে এইসব পুষ্টি জাতীয় খাদ্য সহ আক্রান্ত পরিবারগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো। এছাড়া বিভিন্ন পুষ্টিবিদ ও ডাক্তারদের সাথে আলোচনা করা হচ্ছে বলেও জানান কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রধান এই নির্বাহী।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশনের উক্ত উদ্যোগের সাথে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.খায়রুল চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে এ ধরণের নানা রোগ বালায় এবং সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া কখনো সাজেকে দুর্ভিক্ষ বা কখনো লামায়। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের এত বছর পরও এইসব দেখা দেওয়া এবং হামে শিশু মারা যাওয়া মানে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ার এক একটি লক্ষণ। পাহাড়ে যে উন্নয়ন হচ্ছে দাবী করা হয় সে উন্নয়ন আসলে সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করতে পারছে না বলেও অভিমত এই সমাজ বিজ্ঞানীর।
তিনি আরো বলেন, সাজেককে এখন জনপ্রিয় ‘ট্যুরিষ্ট স্পট’ করা হয়েছে। যার ফলে সেখানে প্রকৃতিগত পরিবর্তন এসেছে। এ পর্যটনে স্থানীয় আদিবাসীরা সুফল না পাওয়াতে তারা দিনি দিন প্রান্তিক ও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টিগত চাহিদা মিটছে না। যার ফলে সেই সাজেকে এখনো হামে শিশু মারা যাচ্ছে। সরকার যে প্রতিবছর বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদানে শতভাগ শিশুকে এর আওতায় নিয়ে আসার কথা বলছে তাতে এই শিশুরা নেই বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
বৈশ্বিক চলমান করোনা পরিস্তিতি নিয়ে তাঁর মতামত তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, পুজিবাদীরা কেবল বাজার চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সবকিছু দখল করেছে। সাজেক বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য। চলমান বৈশ্বিক পরিস্তিতি উত্তোরণের পর আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা রক্ষার লড়াইটি ক্রমশ মানুষ প্রজাতি রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হওয়ার মত বাস্তবতায় পৌঁছাতে বিশ্ব নেতাদের উপলব্ধি আশাবাদও ব্যক্ত করেন এই আদিবাসী গবেষক।
মুঠোআলাপে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং আইপিনিউজকে বলেন, পাহাড়ের আদিবাসীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সরকারের অনীহা বা উদাসীনতা দীর্ঘদিনের। পাহাড়ে হামে শিশু মৃত্যুই এই উপেক্ষার বহি:প্রকাশ। পাহাড়ের আদিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের আরো বিশেষ নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য কর্মীরা যেন পাহাড়ের দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকায় যায় সেজন্য তাদেরকে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন এই আদিবাসী নেতা। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদ সহ সরকারকে আরো যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করারও জোর দাবী করেন বিশিষ্ট এই কলামিস্ট।
অন্যদিকে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল আইপিনিউজকে বলেন, পাহাড়ে হামে আক্রান্ত হয়ে এত শিশু মৃত্যুর ঘটনা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। প্রদীপের নিচের অন্ধকার যেমন তেমনি সাজেকের পর্যটনের রমরমা চাকচিক্যের আড়ালে হামে শিশু মৃত্যুও তেমন। অথচ সাজেকের মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই বলেও দাবী করেন তিনি।
বিশিষ্ট এই আদিবাসী গবেষক আরো বলেন, স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত না করে কাজ করলে যেরকম হওয়ার কথা এটাও ঠিক সেরকম। বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা শতভাগ নিশ্চিতকরণে সরকারের যে কর্মসূচী রয়েছে সেখানে স্থানীদের ট্রেনিং দিয়ে সম্পৃক্ত করার কথাও জানান তিনি।
এছাড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনকে স্থানীয়দের দ্বারা শক্তিশালী না করার কারণেও এ ধরণের পরিস্তিতি তৈরী হয়েছে বলে দাবী করেন তিনি। মূলত সব মিলিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করার প্রতিফলন হিসেবেই দেখছেন এই ইতিহাসবিদ।