জাতীয়

খাগড়াছড়িতে জুম্মদের উপর হামলার ঘটনায় ঢাবি’তে বিক্ষোভ সমাবেশ

অমর শান্তি চাকমা: খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক সোহেল রানা কর্তৃক জুম্ম ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনায় জুম্মদের উপর সেটলারদের সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে অদ্য ২ অক্টোবর, ২০২৪ পাহাড়ের নিপীড়িত ছাত্র জনতার উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য পাদদেশে এক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কুর্ণিকোভা চাকমা বলেন, আমরা আদিবাসীরা শান্তি চাই, আমরা আমাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই, আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিন। সোহেল রানা নামক এক ধর্ষকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ী মানুষদের উপড় সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানায় এবং হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানাচ্ছি।

সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক রুবেল চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, কয়েকদিন আগেও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা নিয়ে আমরা রাজু ভাস্কর্যে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবারো সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ। তিনি বলেন, পার্বত্য এলাকায় সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন সর্বদা পক্ষপাতদুষ্ট আচরন করে। এ ধরণের প্রশাসন আমরা চাই না।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের মানুষেরা এখনও অবধি শান্তির পথে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট রয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষ অধিকার আদায়ে কি করতে পারে তা আপনারা অতীতে দেখেছেন এবং ভবিষ্যতেও এরকম অবস্থা হলে নিপীড়িত ছাত্র জনতা রক্ত দিতেও পিছপা হবেনা।

বাংলাদেশ বৌদ্ধ ছাত্র সংসদের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক রিপন বড়ুয়া বলেন, পাহাড়ের আদিবাসী বন্ধুরাও সক্রিয়ভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে কেন পাহাড়ে এত বৈষম্য। সমতলে যারা নানা অপরাধী কর্মকান্ডে জড়িত সেসব কুলাঙ্গারদেরকে কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলী করা হবে? তাহলে কি পাহাড়কে পানিসমেন্ট জোন হিসেবে বিবেচনা করা হয়?

তিনি আরো বলেন, যে গৌতম বুদ্ধ আজীবন অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন আজকে তার মূর্তি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। শান্তিপ্রিয় পাহাড়ী মানুষদেরকে বারবার হামলা করা হচ্ছে। তিনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে ঘটনার দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানান।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দীন শুভ সমাবেশের সাথে সংহতি এবং ঘটনার দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়ে বলেন, দেশের এ সময়ের অস্থিতিশীল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সাম্ঘপ্রদায়িক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।

সমাবেশে উপস্থিত অংশগ্রহনকারীদের একাংশ।

তিনি প্রশাসনকে প্রশ্ন করে বলেন, যে ব্যক্তির নামে ইতিমধ্যেই ২ টি ধর্ষণের মামলা রয়েছে, সে কিভাবে আবারো শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়? তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যে আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ আপনাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়েছে সে আকাঙ্খার যথার্থ প্রতিফলন ঘটান। তিনি পাহাড় এবং সমতলের সকল মেহনতী মানুষর সংগ্রাম-সংকটে ছাত্র ইউনিয়ন পাশে থাকবে বলেও ঘোষণা করেন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের, মিরপুর শাখার সহ-সভাপতি অভি চাকমা বলেন, আমরা এমন এক দেশে বাস করি যেখানে চোরকে চোর বলা যায় না, ধর্ষককে ধর্ষক বলা যায় না। বললে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হতে হয়। ধর্ষকের কোন জাত নেই, সম্প্রদায় নেই। একজন পিতৃতূল্য শিক্ষক যখন ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তখন কেন তার বিচার হবেনা। কিভাবে তিনি পুনরায় স্বপদে বহাল থাকতে পারেন।

তিন আরো বলেন, খাগড়াছড়ির সেটলার কর্তৃক সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাস্থল থেকে সেনাক্যাম্প মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে কিন্তু নিরাপত্তাবাহিনীরা ঘটনাস্থলে আসতে সময় নেয় ৩ ঘন্টা। প্রশাসনের এ ধরণের নিরব ভূমিকার কারণে বারবার এ ধরণের সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ী জনগোষ্ঠী যদি জুমল্যান্ড চায়তো তাহলে ১৯৯৭ সালে দেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করতো না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিলো। এ চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হলে এসকল সমস্যার সৃষ্টি হতোনা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিষয়ে দেওয়া বক্তব্যকে নিন্দা জানিয়ে বলেন, তাঁর যদি স্বদিচ্ছা থাকে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন তার ক্ষমতাকালীন সময়েই সম্ভব।

বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্তনী রেমা বলেন, বাংলাদেশ নামক এ ভূখন্ডে বাঙালী ছাড়াও ৫৪ টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এ আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবসময় সম্পৃক্ত হতে চায়। কিন্তু এ রাষ্ট্রযন্ত্র এ জনগোষ্ঠীদের সর্বদা বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করছে। যার ফলে জন্য প্রতিনিয়ত তাদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ধর্ষকের কোন জাত হতে পারে না। সে যেই জাতিরই হোক ধর্ষককে ধর্ষক-ই বলতে হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী একটি আশাহীন ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্খার জন্য আদিবাসীরাও রক্ত ঝরিয়েছিলো। কিন্তু সারাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপড় প্রতিনিয়ত দমন, পীড়ন, হামলা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্র সংস্কারের একটি অংশ। সুতরাং আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ অবিলম্বে সাম্প্রদায়িক হামলায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

সমাবেশ শেষে বিক্ষোভকারীরা একটি মিছিল বের করে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, পাহাড়ী মানুষ যেমন কোন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের সমর্থন করেনা তেমনি সাম্প্রদায়িক হামলারও বিরোধতা করে। যে ব্যক্তি ধর্ষণের দায়ে ২ বছর কারাবন্দী ছিলেন, তিনি কিভাবে বহাল তবীয়তে এখনো শিক্ষক থাকতে পারেন। কেন সেই শিক্ষকরূপী পশুকে যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়নি।

তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শহরে বসবাসরত আদিবাসী জনগণের উপড় প্রতিনিয়ত হুমকি দামকি দেওয়া হচ্ছে। আজকে এ ব্যাপারে প্রশাসন কোন পক্ষেপ নিচ্ছে না। রাষ্ট্র যদি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক হয় তাহলে আদিবাসীদের উপড় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর বিচার করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অন্যায় যেখানে নিয়ম হয়ে ওঠে, প্রতিবাদ সেখানে কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী সে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে তার জবাব দেবে। তিনি পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের চলমান আন্দোলনে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশটি সভাপতির বক্তব্যের পরে প্রতিবাদী মিছিল আকারে গিয়ে শাহবাগে সমাপ্ত হয়। সমাবেশটির সঞ্চালনা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগরের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হ্লামংচিং মারমা।

Back to top button