আলফ্রেড সরেন হত্যা: বিচারহীনতার ২০ বছর

সতেজ চাকমা: আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন । ২০০০ সালের ১৮ আগষ্ট ভূমিদস্যুদের অতর্কিত আক্রমণে হত্যার শিকার হন এই নেতা।সেই হত্যার বিচারের অপেক্ষায় কেটে গেলো ২০ টি বছর। আগামীকাল ১৮ আগষ্ট বহুল আলোচিত নওগাঁর আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের ২০ তম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০ বছর আগে এদিন ভূমি দস্যুদের হাতে নির্মম ভাবে নিহত হন । সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে এই নির্মম হত্যাকান্ড। দেশের প্রতিতযশা বুদ্ধিজীবি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংস্কৃতিক কর্মীরা আলফ্রেড সরেননের সেই হত্যার প্রতিবাদ জানান সম্মিলিতভাবে । আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় নিহতের বড় ভাই কমল সরেন ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।
এমন আলোচিত ঘটনায় করা দু’টি মামলার ২০ বছর পরেও সেটির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের রয়েছে বহু সংশয়। স্থানীয় আদিবাসীদের অভিযোগ জামিনে থাকা আসামীরা তাদের অব্যাহত ভাবে হুমকি-ধামকি দেয়ায় এরই মধ্যে অনেক আদিবাসী পরিবার নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুরের সেই আদিবাসী পল্লী ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, ভূমিদস্যুরা এখনো ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে যে ক’টি পরিবার এখনো বসবাস করছে তারা ভূমিদস্যুদের ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতে পারছে না। ফলে পরিবারগুলো চরম দারিদ্রতা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। পল্লী ছেড়ে মামলার সাক্ষীরা চলে যাওয়ায় উক্ত দু’টি মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদী তাঁর ছোট বোন রেবেকা সরেন।
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীর স্থানীয় এক আদিবাসী নেতার সাথে কথা বলে জানা যায় যে, আলফ্রেড হত্যা মামলার জামিনে থাকা আসামীদের অব্যাহত হুমকি-ধামকিতে ২৪টি পরিবারের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৯টি পরিবার সেখানে অবশিষ্ট রয়েছে। অন্যান্যরা প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র চলে গেছে। তবে অন্য স্থান থেকে এখানে এসে নতুন ৯ টি পরিবার বসবাস শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।
এ নিয়ে মতামত জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং আইপিনিউজকে বলেন, ২০০০ সালে এ ঘটনা ঘটার পর সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। আমি নিজেও বিশিষ্টজনদের সাথে সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু এতবড় সাড়া জাগানো ঘটনার ২০ বছরেও বিচার না হওয়াটা এই রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের জন্য লজ্বার এবং খুবই দু:খজনক। সাড়া জাগানো এ ঘটনার বিচার না হওয়াতে বুঝা যায় প্রান্তিক আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবাধিকার লংঘনের অন্যান্য ঘটনাগুলোর কী করুণ অবস্থা ।
মুঠো আলাপে তিনি আরো বলেন, এ ঘটনার বিচার না হওয়ায় পুরো একটা গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এই ঘটনার বিচার না হওয়ায় সেই গ্রামে যারা এখনো বেঁচে আছে তারা অধিকারহীন ও মর্যাদাহীনভাবে কোনো মতে টিকে আছে। বিচার হীনতার সংস্কৃতির ফলে আমাদের দেশে বিচার প্রার্থী প্রান্তিক আদিবাসী মানুষ করুনভাবে দিনযাপন করছেন বলেও জানান তিনি।
সঞ্জীব দ্রং আরো বলেন, আমরা আশা করবো দেরীতে হলেও সরকার এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করবে। অপরাধীরা দেরীতে হলেও জানুক কোনো ধরণের অপরাধ করলে কেউ রেহাই পায় না। গণতন্ত্র,
রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের মর্যাদার স্বার্থে নতুন করে তদন্ত করে এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচারও দাবী করেন এই আদিবাসী নেতা।
এদিকে এ বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল আইপিনিউজকে বলেন, এ ধরণের আলোচিত ঘটনার বিচার না হওয়া মানে এটাই প্রমাণ করে যে এই দেশে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। এদেশের প্রান্তিব মানুষ ও আদিবাসী মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবাধিকার লংঘনের বিচার না হওয়া মানেই এটাই প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র এ ধরণের ঘটনাগুলোর বিচার করতে চাইনা।দেরীতে হলেও আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার দাবী করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট এই অধ্যাপক।
উল্লেখ্য যে, ১৮ আগষ্ট ২০০০ সালে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে হাতেম-গদাই গংদের সন্ত্রাসীদের হামলায় আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন নৃসংশভাবে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে ঐ আদিবাসী পল্লীর ১১টি পরিবারের বাড়িঘরে ব্যাপক ভাংচুর লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তাদের হামলায় আদিবাসী নারী-শিশুসহ অন্তত ৩০ জন মারাত্মক আহত হয়। ওই সন্ত্রাসী ঘটনার পর নিরপত্তার জন্য সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হলেও পরে তা গুটিয়ে নেয়া হয়।
আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার বড় ভাই কমল সরেন ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এর মধ্যে পুলিশ কয়েক জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় এবং ৪১জন সাক্ষীর মধ্যে সেই সময় ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। ৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। ওই সময় পলাতক সীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই (প্রয়াত) ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের অধিক আসামি জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে জননিরাপত্তা আইনের সকল রিট হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়। এর ফলে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর বাদিগণ অ্যাপিলেড ডিভিশনে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি অ্যাপিলেড ডিভিশন শুনানী অন্তে পূর্নাঙ্গ শুনানীর জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রেরন করেছে। উক্ত রিটগুলো দ্রুত শুনানী করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান স্থানীয় আদিবাসীরা। আলফ্রেড সরেনের রেখে যাওয়া চার বছরের কন্যা ঝর্না সরেন এখন চব্বিশ বছরের তরুণী। দেরীতে হলেও তাঁর বাবার হত্যার বিচার দাবী এই আদিবাসী তরুণীর।
এ উপলক্ষ্যে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ আগামীকাল ১৮ আগষ্ট নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। বেলা ১১টায় ভীমপুরে আলফ্রেড সরেনের সমাধীতে পুস্পস্তবক অর্পন করে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালনসহ সমাধি প্রাঙ্গনে আলোচনা সভা ও স্থানীয় কদমতলীর মোড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে বলে জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। এছাড়া স্থানীয় বামদলগুলোর উদ্যোগেও কদমতলীর মোড় থেকে আলফ্রেড সরেনের সমাধী প্রর্যন্ত পদযাত্রার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।