আদিবাসী নারীর উপর ক্রমাগত সহিংসতায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদী মানববন্ধনের মূল বক্তব্য

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার জাতীয় জাদুঘরের সামনের প্রাঙ্গনে, শাহবাগ, ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ,বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ,বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী মানববন্ধনের মূল বক্তব্য-
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমরা আজ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আমাদের বেদনা, ক্ষোভ, হতাশা ও প্রতিবাদ জানাতে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছি। আপনারা জানেন, গত কয়েকদিনে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতা, নিপীড়ণ ও নির্যাতনের পর পর কয়েকটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে রাত প্রায় আড়াইটার সময় খাগড়াছড়ি সদরের ১ নং গোলাবাড়ি ইউনিয়নের বলপিয়ে আদাম নামক গ্রামে নিজ বাড়িতে দরজা ভেঙ্গে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ৯ জন সেটেলার বাঙালী মানসিক প্রতিবন্ধী এক চাকমা নারীকে (২৬) গণধর্ষণ ও তাদের বাড়িতে লুটপাট করেছে। এছাড়াও গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ দীঘিনালায় এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক এক আদিবাসী স্কুল ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয় এবং গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ সন্ধ্যা ৫.৩০ টার সময় মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার ৭নং আদমপুর ইউনিয়নের কাটাবিল গ্রামের বাসিন্দা উমেদ মিয়া কর্তৃক মনিপুরী এক নারী (৬০) শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। কোভিড মহামারীর এ সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতা, নিপীড়ণ ও নির্যাতনের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাশাপাশি, গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে মধুপুরগড় অঞ্চলের পেগামারী গ্রামের বাসন্তী রেমার ৪০ শতক জায়গার পুরো কলাবাগান স্থানীয় বনবিভাগ বিনা নোটিশে কেটে ফেলে দেয়। এটা এক চরম মানবাধিকার লংঘন।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ২০১৯ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪৫ শতাংশেরও বেশি নারী কর্মক্ষেত্রে বা প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বহু ধরণের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৬১ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা বাজার এলাকায়, ৪৫ শতাংশ মাঠে, ৬ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ৩ শতাংশ কর্মস্থলে সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন। আবার, ৩৩ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতন, ৩৮ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ১৯ শতাংশ অর্থনৈতিক নিপীড়ণ এবং ৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। অপরদিকে, কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে জানা যায়- ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৬টি আদিবাসী নারীর উপর সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ১৪টি সমতল অঞ্চলে এবং বাকী ১২টি পার্বত্য অঞ্চলে। যৌন বা শারীরিক নির্যাতনমূলক ৩৩টি ঘটনার মধ্যে ১২টি পাহাড়ে এবং ২১টি সমতল অঞ্চলে। এসব ঘটনায় কমপক্ষে ৭ জন আদিবাসী নারীকে ধর্ষণ এবং ৫ জন আদিবাসী নারী ও কিশোরীকে হত্যা বা ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর ৭ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যান্যের মধ্যে ৩ জনকে গণধর্ষন ও ৬ জনকে শারীরিক নির্যাতন এবং ২ জনকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। আর ২০১৮ সালে প্রায় ৫৩ জন আদিবাসী নারী ও শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে সমতলে ২২ জন আর ৩১ জন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে।
সমতলের আদিবাসী নারীরাও নানাভাবে জাতিগত নিপীড়ণ, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তারমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে সংঘটিত আদিবাসী মুনিপুরি নারীর উপর নির্যাতনের ঘটনাটি অন্যতম। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ হার অত্যন্ত বেশি।
উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান এবং পার্বত্য অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পরও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে বিশেষত সেটেলার বাঙালি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বলা যায়, প্রতিমাসেই পাহাড়ের আদিবাসী নারীরা কোন না কোন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেই। মূলত বিচারহীনতা সংস্কৃতির কারণে এধরনের ঘটনা বারংবার ঘটছে। দুঃখের বিষয় হলো, তবুও এ বিষয়ে আমরা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ লক্ষ্য করছি না।
কিন্তু এসমস্ত সহিংস ঘটনার জন্য রাষ্ট্র, সরকার, বিচার বিভাগ, প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনী কেউ এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। রাষ্ট্র , সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত না হওয়া ও চুক্তির আলোকে এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন কার্যকর না হওয়ার কারণে পাহাড়ের আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদি এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্যে ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে আমরা মনে করি। সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্যে যেহেতু আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে তাই পার্বত্য নারীদের প্রতি সহিংসারোধের জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দৃষ্টি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য. এ সমস্ত কিছু কিছু ঘটনায় আসামীরা গ্রেপ্তার হয় বটে কিন্তু কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পায়। সাস্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোতে বিশেষ করে খাগড়াছড়িতে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা যেন আইনের ফাঁক দিয়ে বের হতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
আমাদের দাবিনামা:
১। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত আদিবাসী নারীর উপর নিপীড়ণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও সহিংস সকল ঘটনায় জড়িত দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করতে হবে;
২। ঘটনার শিকার আদিবাসী পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণসহ নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে;
৩। আদিবাসী নারীসহ নারীর প্রতি সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে;
৪। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য নারীদের সকল ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে একটি বিশেষ সেল গঠন করতে হবে;
৫। অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূণার্ঙ্গ বাস্তবায়নসহ চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে এবং সেটেলার বাঙালীদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন করতে হবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক
হিল উইমেন্স ফেডারেশন
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ